আহাদ (রবিবার), ২৭ অক্টোবর ২০২৪

পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন মির্জা ফখরুল?

নিউজ ডেস্ক:

ঘটনা এ বছরের ১৩ জানুয়ারির। গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আদালতেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সচরাচর শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে হ্যাঁ-না’র মধ্য দিয়ে চেয়ারপারসনের মতামত জেনে নেন মির্জা ফখরুল। কিন্তু ওইদিন পরিস্থিতি ছিল একটু ভিন্ন। দলের ভেতরে-বাইরে চলছিল নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়ের পর্যালোচনা। স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ কয়েকজন নেতার কণ্ঠে উচ্চারিত ছিল—দল পুনর্গঠন এবং কাউন্সিলের বিষয়টি। ওই অবস্থায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ‘মহাসচিব’ পদের প্রতি অনেক নেতার দৃষ্টি ছিল নিবদ্ধ। কারাগারে দলীয় প্রধান, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাইরে। এ অবস্থায় বিএনপির নেতৃত্বের দৃশ্যমান নাটাই ফখরুলের হাতে। এ অবস্থায় চেয়ারপারসনের মতামত জেনে নেওয়া ছিল মির্জা ফখরুলের জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি। আর সেদিনই নিশ্চিন্ত হয়ে এসেছেন তিনি, চেয়ারপারসনের কাছে এতটুকুও গুরুত্ব কমেনি তার।
আদালতে সেদিন খালেদা জিয়ার কাছে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন মির্জা ফখরুল। তার ভাষ্য ছিল—‘নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় দলের ভেতরে-বাইরে নানা আলোচনা চলছে। সেক্ষেত্রে তার নিজের পদের বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কিনা। তিনি মহাসচিব পদ থেকে পদত্যাগ করবেন কিনা।’ মির্জা ফখরুলের মুখে এমন প্রসঙ্গ শুনে সরাসরি তা নাকচ করে দেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, ‘তুমি কেন ইস্তফা দেবে। ভোট তো হয়েছে ২৯ ডিসেম্বর রাতে। সেখানে নেতাদের কী করার আছে।’
মহাসচিবের ঘনিষ্ঠ একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তির দাবি, খালেদা জিয়া মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে ‘তুমি’ বলেই সম্মোধন করেন।
আদালতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের এ বিষয়ে কোনও কথা হয়েছিল কিনা, এমন প্রশ্নে সরাসরি কোনও নেতাই বাংলা ট্রিবিউনের কাছে মন্তব্য করতে রাজি হননি। যদিও মির্জা ফখরুলের প্রতি দলীয় চেয়ারপারসনের এই ভরসার কথা এখন দেশের ভিন্ন কয়েকটি রাজনৈতিক দলের প্রধানদের মুখেও।
এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল এ প্রতিবেদকের প্রশ্নে খানিকটা বিরক্তই বোধ করেন। জানতে চান, ‘কে বললো আপনাকে এসব কথা?’
রবিবার (৩ মার্চ) দুপুরে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘গসিপ নিয়ে, গল্প নিয়ে কথাবার্তা কেন? কী জিজ্ঞেস করবেন, এটা নিয়ে। আপনারা তো বিএনপির পেছনে লেগে আছেন। দেশ চলে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে তো আপনারা কথা বলছেন না।’
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সোচ্চার ছিলেন দল পুনর্গঠনের বিষয়ে। গত এক-দুই মাসে দলের অভ্যন্তরে এ নিয়ে নানা আলোচনাও ছিল।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, ‘মহাসচিব তার পদ থেকে সরে যাবেন, থাকবেন না—এমন কানাঘুষা তো নির্বাচনের পরে শুনেছি। তবে তিনিই থাকছেন। এখন পর্যন্ত এ বিষয়টি মীমাংসিত।’
রবিবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দুটি দলের প্রধান এবং দুটি বাম দলের দলীয় প্রধান সঙ্গে আলাপকালে মির্জা ফখরুলের বিষয়টি সম্পর্কে অবগত বলে জানান। তাদের মধ্যে একজনের ভাষ্য—‘খালেদা জিয়া মির্জা ফখরুলের ওপর এখনও আস্থা রেখেছেন। মির্জা ফখরুল দলের প্রতি কমিটেড এবং এটা বেগম জিয়ার সঙ্গে আলাপকালেও তাকে বলা হয়েছে যে—পদে থাকতে হবে।’

স্থায়ী কমিটির দুইজন সদস্যের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ হয় । আইন পেশায় সুপরিচিত স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘ম্যাডামের কাছে সরাসরি মহাসচিব পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথা তিনি (ফখরুল) বলেছেন কিনা জানি না। তবে তিনি বলতেই পারেন। কারণ, তাকে তো ম্যাডামই নিয়োগ দিয়েছেন। ফলে, তিনি না বললে মির্জা ফখরুল রিজাইন করবেন না। এখন তো প্রশ্নই ওঠে না।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য বলেন, ‘মির্জা ফখরুলকে সরানোর বিষয় তো না। প্রশ্নটা উঠেছিল কেন আমরা ইলেকশন করলাম। নির্বাচনের আগে তো কথা উঠেছিল, ৩০০ এমপি প্রার্থীকে ঢাকায় ডেকে এনে নির্বাচন ফেয়ার করার দাবিতে ইসির সামনে যাওয়া এবং সেই নির্বাচন বয়কট করা উচিত ছিল। কিন্তু সেক্রেটারি জেনারেল (মির্জা ফখরুল) বললেন, নির্বাচনের মাঝখানে ডাকা যেত। কিন্তু প্রার্থীরা কি নির্বাচনের আগে এলাকা ছেড়ে আসতো?’
মহাসচিবের ঘনিষ্ঠ দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ১৩ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসার পরই মহাসচিব তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে জানিয়েছেন, ‘দলীয় প্রধান তার প্রতি সন্তুষ্ট আছেন।’

মির্জা ফখরুলের এ বিষয়টি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের কানেও গেছে। রবিবার সন্ধ্যায় বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘চেয়ারপারসন এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে মির্জা ফখরুলের দায়িত্বই তো বেশি। কিন্তু অনেক সমালোচনাও হয়েছে। নির্বাচনকালীন সময়ের পদক্ষেপ যেগুলো নেওয়া, সেগুলো তো ঠিকমত হয়নি। যেমন নির্বাচনের দিন তিনি সকাল ১০টায় বলেছেন, নির্বাচন ভালো হচ্ছে বা এরকম। এরকম কিছু সমালোচনা তো এসেছে। সরকারের যেমন গোয়েন্দা উইংস আছে, তার কাছে সব খবর চলে আসে। মির্জা ফখরুল তো বিরোধী দলের নেতা। তারও তো এরকম সেটাপ থাকা উচিত ছিল। সুতরাং, ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন এবং ২৯ ডিসেম্বর রাতে কী হয়েছে, সেটা তো তার কানে যাওয়া উচিত ছিল। সরকারের মতো সম্ভব না হলেও ধারণা তো অন্তত তার নেওয়া উচিত ছিল।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ আরও বলেন, ‘মির্জা আলমগীর ওই সময়টায় সমালোচনায় পড়েছিলেন। কিছু কিছু সমালোচনা তো ড. কামাল হোসেনদের নিয়েও হয়েছে। এসব ব্যাপার নিয়েই তার হয়তো উপলব্ধি ছিল, ম্যাডামকে বলতে পারেন, নিজেই সরে যাবো। কিন্তু সময়টা সরে যাওয়ার না, সময়টা পাল্টা ঘুরে দাঁড়ানোর। এখন সবাই মিলে একসঙ্গে বসে আগামী দিনের কৌশল ঠিক করতে হবে। রেজিগনেশন… এসব বাদ দিতে হবে।’
এদিকে, রবিবারও (৩ মার্চ) পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের অস্থায়ী আদালতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কয়েকবার কথা বলেন মির্জা ফখরুল, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ কয়েকজন।
এ বিষয়ে মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘বেগম জিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক কোনও বিষয়ে আলোচনা হয়নি। শারীরিক বিষয়ে হয়েছে। তার শরীর খুবই অসুস্থ। কারও সহযোগিতা ছাড়া তিনি উঠতে-বসতে পারছেন না। তার জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা প্রয়োজন।’

খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যবস্থা করার আবেদন

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, ‘আমাদের আইনজীবীরা কোর্টে বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য আবেদন করেছেন।’

রবিবার দুপুরে মির্জা ফখরুল পুরান ঢাকার বিশেষ আদালত থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে প্রপার ট্রিটমেন্ট দেওয়া হচ্ছে না। শুধুমাত্র একদিন এসে ডাক্তার দেখে গেছেন। এখন পর্যন্ত পরীক্ষার জন্য তার রক্তের নমুনা নেওয়া হয়নি। তিনি একজন ডায়াবেটিসের রোগী। নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা দরকার, তাও করা হচ্ছে না।’ মির্জা ফখরুল বলেন, ‘মামলাগুলো থেকে তার (খালেদা জিয়া) জামিন পাওয়া উচিত, কিন্তু জামিন তো পাচ্ছেন না। আমরা তো লিগ্যাল মুভ করছি।’

Facebook Comments Box