খামিছ (বৃহস্পতিবার), ২৮ মার্চ ২০২৪

মৃত শিল্পাঞ্চলে পরিনত হয়েছে খুলনার শিল্পাঞ্চল

মৃত শিল্পাঞ্চলে পরিনত হয়েছে খুলনার শিল্পাঞ্চল

নিউজ ডেস্ক : খুলনার শিল্পাঞ্চল এখন মৃত শিল্পাঞ্চলে পরিনত হয়েছে। বেসরকারি ব্যক্তিমালিকানা অধিকাংশ জুট মিল গুলো শ্রম আইন লঙ্ঘন করে বছরের পর বছর বন্ধ করে রাখা হয়েছে। মিলগুলোর মালিকগণ প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ৬শ’ ৭০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়েছে।

এ সকল মিলের শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রায় ১শ’ ৫০ কোটি টাকা বকেয়া পাওনা রয়েছে যা পরিশোধ না করে বছরের পর বছর মিলগুলো বন্ধ করে রেখেছে। এর মধ্যে কয়েকটি মিল আংশিক চালু রেখে শ্রমকি-কর্মচারীদের বকেয়া পাওনা পরিশোধ না করে ফায়দা লুটছে এমন অভিযোগ শ্রমিক-কর্মাচরী ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দের। তাদের দাবী মিলগুলোর মালিক শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ না করায় অনাহারে-অর্ধাহারে প্রায় শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে এবং শতশত শ্রমিক অর্থ অভাবে বিনাচিকিৎসায় ধুকেধুকে মৃত্যু পথযাত্রী।

শ্রমিকদের বকেয়া পাওনার দাবীতে ফেডারেশন দ্রুত ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসুচি নিয়ে মাঠে নামার ঘোষনা। বেসরকারি পাট-সুতা বস্ত্রকল শ্রমিক-কর্মচারী ফেডারেশন এবং শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সৃুত্রে জানাগেছে, খুলনা অঞ্চালের সোনালী জুট মিলস, এ্যাযাক্রা জুট মিলস, মহসেন জুট মিলস, শিরোমণি ট্রান্সওশেন ফাইবার্স প্রোসেসার্স লিমিটেড, জুট স্পিনার্স, আফিল, এফ আর, নওয়াপাড়া, সাগর, সুপার, আয়ান, স্পেলাইজিষ্ট, মন্ডল, গ্লোরি, সিডলু, আহাদসহ ছোট-বড় মোট ২২টি জুট মিল রয়েছে। এর মধ্যে সোনালী,

এ্যাযাক্রা, মহসেন, জুট স্পিনার্স, আফিল, এফ আর, স্পেশালিজিস্ট সম্পুর্ণ বন্ধ রয়েছে তবে সোনালী জুট মিলস গত সপ্তাহে আংশিক চালু করা হরা হয়েছে। এছাড়া আংশিক চালু নওয়াপাড়া ও সাগর জুট মিল এবং খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে আয়ান, সুপার, গ্লোরী, মন্ডল, সিডলু ও আহাদ জুট মিল। এ সকল জুট মিলের মধ্যে শুধুমাত্র ৭টি ব্যক্তিমালিনা জুট মিলের মালিকদের কাছে বিভিন্ন প্রায় ৬শ’ ৭০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ রয়েছে।

এ সকল মিলের শ্রমকি-কর্মচারীদের মালিক কর্তৃপক্ষের কাছে বকেয়া পাওনা রয়েছে প্রায় ১শ’ ৫০কোটি টাকা। ব্যাংক থেকে শতশত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা পরিশোধ না করে ঋণের টাকা অন্যখাতে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। এমনকি মিলগুলো পুর্ণাঙ্গ ভাবে চালানোর কোন পরিকল্পনা লক্ষ করা যাচ্ছেনা। এ সকল জুট মিলের মধ্যে সোনালী, এ্যাযাক্রা এবং মহাসেন, আফিল, জুটস্পিনার্সসহ কয়েকটি জুট মিলের প্রায় শতাধিক শ্রমিক অনাহারে বিনাচিকিৎসায় মৃত্যু বরণ করেছে।

অনেকে টাকার অভাবে বিনাচিকিৎসায় ধুকেধুকে মৃত্যু পথযাত্রী। এছাড়া মিলগুলোর প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক পরিবার অত্যান্ত মানবেতর জীবনযাপন করছে। শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া মজুরী পরিশোধ, মিল চালুসহ বিভিন্ন দাবীতে ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসুচি নিয়ে নতুন করে মাঠে নামার ঘোষনা দিয়েছে ফেডারেশন নেতৃবৃন্দ। খুলনাঞ্চালের বেসরকারি ব্যাক্তি মালিকানা জুট মিলের মধ্যে শিরোমনি শিল্পাঞ্চলের বন্ধকৃত মহসেন জুট মিল ১৯৬৯ সালে চালু হলে ১৯৭২ সালে মিলটি সরকারি করন করা হয় এবং ১৯৮৩ সালে পুনরায় ব্যাক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে ১৭ জুলাই মিলে স্থায়ী এবং অস্থায়ী মোট ১২শ’ শ্রমিক-কর্মচারীকে একযোগে ছাটাই করা হয়।

মিল কর্তৃপক্ষের কাছে এ সকল শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া পাওনা রয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। বকেয়ার দায়ে মিলটির বিদ্যুৎ সংযোগ বিছিন্ন রয়েছে। সৃত্র বলছে মিলটি রুপালী ব্যাংকের কাছে ৪০ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। শিল্পাঞ্চালের বন্ধকৃত জুট স্পিনার্স ১৯৮১ সালে যাত্রা শুরু করে। মিলের মোট শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা ১৭শ’ ৩০ জন। মিলটির মালিক মো. সামছুজ্জোহা কোন নোটিশ ছাড়াই গত ২০১৬ সালের ২৫ আগস্ট থেকে মিলটি অত্যান্ত কৌশলে উৎপাদন বন্ধ রেখে অঘোষিত বন্ধ করে রেখেছেন।

মিলের শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া পাওনা রয়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। বকেয়ার দায়ে মিলটির বিদ্যুৎ সংযোগ বিছিন্ন রয়েছে। মিলটি জনতা ব্যাংকের নিকট ৪২ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে বলে জানাগেছে। মীরেরডাঙ্গা শিল্পাঞ্চালের ব্যাক্তি মালিকানা এ্যাযাক্রা জুট মিল ১৯৭২ সালে প্রথম সরকারি ভাবে চালু করা হয়। পরে মিলটি ব্যাক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হয় বর্তমানে বন্ধকৃত এই মিলের শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ২ হাজার এদের মধ্যে কিছু কিছু শ্রমিকের বকেয়া পাওনা পরিশোধ করা হলেও এখন শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রায় ১২ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। মিলটি সোনালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে প্রায় ১শ’ ২৫ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে বলে ফেডারেশন সুত্র জানিয়েছেন।

এই অঞ্চলের এক সময়ের সুমানধণ্য সোনালী জুট মিলস ১৯৭২ সালে চালু হলে ৪ হাজার ৭শ’ জন শ্রমিক-কর্মচারীর পরিবার জীবন জীবিকা নির্বাহ করতেন মিলটি। পরে মূল মালিক জহুরুল হকের মৃত্যুর পর মিলটির অব্যাবস্থাপনায় মিলে ধ্বস নামতে শুরু করে শ্রমিক ছাটায়ের মধ্যে দিয়ে চলে মিলটি। মিল মালিক ইমদাদুল হক বুলবুল বিভিন্ন মামলায় ফেরারী থাকায় মিলটি এক প্রকার সিবিএ এবং কতিপয় কর্মকর্তা দেখভাল করছে বলে অনেকে মনে করেন। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গত সপ্তাহে নামমাত্র মিলটি চালু করা হয়েছে। বর্তমানে মিলে ১৩শ’ ৩০ জন শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত।

মিলের শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া পাওনা রয়েছে প্রায় ৪৮ কোটি টাকা। খুলনা অঞ্চলে বেসরকারি জুট মিলগুলোর মধ্যে সব থেকে বেশি ঋণ গ্রস্থ হয়ে পড়েছে এই মিলটি। মিল কর্তৃপক্ষের কাছে উত্তরা, সোনালীসহ কয়েকটি ব্যাংকের প্রায় ২শ’ ৭০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। শিরোমনির আফিল জুট মিলস ১৯৭২ সালে সরকারি ভাবে চালু হয় পরবর্তিতে মিলটি ব্যাক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়। মিলে বর্তমানে শ্রমিক-কর্মচারী সংখ্যা স্থায়ী এবং অস্থায়ী মিলে ৮শ’ ৬০ জন। মিলের শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া পাওনা রয়েছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা, মিলের বিদ্যুৎ বিল বয়েয়া রয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা।

বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে লোন রয়েছে একশত কোটি টাকার উপরে বলে জানাগেছে। নওয়াপাড়ার সাগর জুট মিলস ১৯৮৩ সালে উৎপাদন শুরু করে। শ্রমিক ছাটাইয়ের পর বর্তমানে আংশিক চালু এই মিলের শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৭শত মতো। বকেয়া পাওনা কিছু পরিশোধ করায় এই মিলের শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা রয়েছে প্রায় ১৩ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংক মিলের কাছে ১শ’ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। বর্তমানে মিলগুলো দিনের পর দিন বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা জীবন জীবিকার তাগিদে অনেকে ভ্যান-রিক্রাা, ইজিবাইক চলিয়ে সংসার চালাচ্ছে। অনেকে আবার দিন মুজুরের কাজ বেছে নিয়েছে।

বেসরকারি পাট, সুতা, বস্ত্রকল শ্রমিক-কর্মাচরী ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম সুবজ বলেন, খুলনাঞ্চালের বেসরকারি জুট মিল গুলোর মালিকরা ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে মিলগুলোকে বন্ধ অথবা নামেমাত্র চালু রেখে শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধ না করায় হাজার হাজার শ্রমিকের পরিবার অত্যান্ত মানবেতর জীবন যাপন করছে। টাকার অভাবে বিনাচিকিৎসায় শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে মিল গুলোর যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে সুষ্ট ও সুন্দর ভাবে মিল চালানো নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

Facebook Comments Box