সাবত (শনিবার), ২৭ এপ্রিল ২০২৪

রিমান্ডে চাঞ্চল্যকর তথ্য: হেভিওয়েট অনেকের নাম সাহেদের মুখে!

ওসি প্রদীপসহ ৭ জন ফের রিমান্ডে

নিউজ ডেস্ক: সাহেদের বিভিন্ন অপকর্মে রাজনীতিবিদ, স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন, সংবা্‌দকর্মী ও প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের অনেকেই যুক্ত ছিলেন। তারা বিভিন্ন সময় তাকে এসব অপকর্মে সহায়তা করেছে তার যথাযথ প্রমাণ বেরিয়ে আসছে। এ অবস্থায় তদন্তকারী কর্মকর্তারা যথেষ্ট বিব্রত। যদিও বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করছে না ডিবি। তবে তদন্ত তদারকির দায়িত্বে থাকা একাধিক সূত্র তথ্যটির সত্যতা নিশ্চিত করেছে। ১০ দিনের রিমান্ডের দ্বিতীয় দিনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে ভুয়া কোম্পানি খুলে বিভিন্ন হাসপাতালে মাস্ক, পিপিই ও লাশ সংরক্ষণের ব্যাগ সরবরাহ করে ভয়ংকর প্রতারক সাহেদ করিম। আলবার্ট গেস্নাবাল গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির নামে এসব মালামাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়েই সরবরাহ করা হয়েছিল।

এদিকে করোনা সনদ জালিয়াতির ঘটনায় রিমান্ডে থাকা আরিফ-সাবরিনা এখনো একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন। পাশাপাশি আরিফের জালিয়াতির বিষয়টি তিনি অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দুইদফা জানিয়েছেন বলেও দাবি করছেন। এ কারণে তাদের বিষয়ে প্রমাণ সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন গোয়েন্দারা। তদন্তের কারণে এখনই ওই কর্মকর্তার নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি ডিবি।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, আলবার্ট নামের একটি কোম্পানি খুলে সাহেদ এক লাখ পিস মাস্ক, ৫০ হাজার পিপিই ও ২০ হাজার লাশ সংরক্ষণের ব্যাগ বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করেন। এজন্য সে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতিও নিয়েছে বলে দাবি করেছে। দুই দিনের রিমান্ডে তার কাছ থেকে পাওয়া এসব নতুন তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। পাশাপাশি সাবরিনা ও আরিফও এখন অনেক বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। এজন্য তাদের নামে পাওয়া প্রতারণার তথ্যগুলো এখন প্রমাণ হিসেবে আদালতে উপস্থাপনের জন্য কাজ করা হচ্ছে। তারা মুখের অস্বীকার করলেও তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ধরনের প্রতারণা থেকে তাদের পার পাওয়া কোনো সুযোগ নেই।

সাহেদের মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার বদরুজ্জামান জিলস্নু বলেন, রিমান্ডের দ্বিতীয় দিনে সাহেদ অনেক কথাই বলছেন। কিন্তু ভয়ংকর এই প্রতারকের কোনো কথায় বিশ্বাস করা হচ্ছে না। এজন্য তার কথার স্বপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করা হচ্ছে।

গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার গভীর রাত পর্যন্ত সাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন গোয়েন্দা পুলিশের উত্তরা বিভাগের কর্মকর্তারা। এ সময় তিনি অনেক হেভিওয়েট ব্যক্তিদের নাম বলে তাদের সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে দাবি করেন। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সময়ে বিপদে পড়লে এসব ব্যক্তিই তাকে সহায়তাও করেছে বলে জানিয়েছেন। বিনিময়ে তারা সাহেদের কাছ থেকে লাভবানও হয়েছেন। উত্তরা পশ্চিম থানা তার হাতের মুঠোয় ছিল বলেও দাবি করেছেন। এ কারণে কোনো ভুক্তভোগী এই থানায় অভিযোগ করতে গেলে থানা থেকে তাদের বের করে দেওয়া হতো বলে দাবি করেছেন। পাশাপাশি ওই থানা ও জোনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাঝেমধ্যে এসব হেভিওয়েট ব্যক্তিরা ফোন করে সাহেদকে দেখে শুনে রাখার কথাও বলতেন। সাহেদ এমন বক্তব্যের পর পুলিশ নতুন করে তদন্ত করে দেখছেন, সাহেদ আশ্রয়দাতার তালিকায় কারা কারা ছিলেন। সূত্রমতে, পলাতক থাকা অবস্থায় তিনি বারবার এসব হেভিওয়েটদের সঙ্গে কথা বলে বাঁচানোর জন্য আকুতিও জানিয়েছেন। কিন্তু তারা এখন আর সাহেদকে চেনেন না বলে দাবি করেন। পরে এক আইনজীবীর সঙ্গেও তার কথা হয়। কীভাবে আত্মসমর্পণ করা যায় ওই আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনাও করেন। তবে শেষ পর্যন্ত কেউ তাকে সহায়তা করতে রাজি হননি। এ কারণে জিজ্ঞাসাবাদের শুরুতেই তিনি তাদের নাম প্রকাশ করা শুরু করেন।

ঢাকা মহানগর গায়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার বদরুজ্জামান জিলস্নু বলেন, পলাতক থাকা অবস্থায় সাহেদ কাদের সাথে যোগাযোগ করেছেন সেটি পরে খতিয়ে দেখা হবে। তবে তার নামে যে প্রতারণার মামলার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো এখন এক সূত্রে গাঁথা হচ্ছে। তিনি ভুয়া সনদ দিয়েছে তার প্রমাণ রয়েছে। সেটি পরীক্ষার জন্য ফরেনসিকে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে রিপোর্ট পাওয়া পর বিষয়টি আদালতে প্রমাণ করা সম্ভব হবে। ডিবি এখন এসব বিষয়ে নজর দিচ্ছে।

সূত্রমতে, গোয়েন্দা হেফাজতে থাকলেও মো. সাহেদ করিমের দাম্ভিকতা এখনো কমেনি। বিন্দুমাত্র অনুতাপও নেই তার মধ্যে। বরং জামিনে বেরিয়ে তিনি আবার তাদের সঙ্গে দেখা করবেন বলে জানিয়েছেন।

সূত্রমতে, সাহেদের করোনার জাল সার্টিফিকেট দেওয়ার বিষয়ে প্রথম অবস্থায় কানাঘুষা শুরু হলে স্বাস্থ্য বিভাগের কয়েকজন ব্যক্তি তার সঙ্গে কথা বলেন। তারা বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি কয়েকজন কর্মীর ওপর দোষ চাপান। এরপর তাদের চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও জানান। এরপর তিনি নিজে স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজনের সঙ্গে দেখা করেন। তার এমন অপকর্মের বিষয় সংবাদকর্মীরা জানার পর তিনি বিষয়টি ধামাচাপা দিতে হেভিওয়েট কয়েকজনকে কাজেও লাগান বলে দাবি করেছেন। এর আগেই তিনি পিপিই, মাস্ক ও লাশ সংরক্ষণের কাজ পান। আলবার্ট গেস্নাবাল গার্মেন্ট কোম্পানির নামে একটি ফেসবুক পেইজ খুলে সেটির মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করেন। এসব মালামাল বানানো হয় বিভিন্ন ছোটখাটো ফ্যাক্টরিতে। এখানেও তিনি প্রতারণার আশ্রয় নেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, গুলশান থানা যুবদলের ও গোপালগঞ্জ বিএনপির এক নেতার শ্যালকের সঙ্গে তার গভীরতার কথা বলেছেন। একই সাথে আওয়ামী লীগের অনেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার রয়েছে বলে জানান। তারা বিভিন্ন সময় সাহেদকে সহযোগিতা করেছেন বলে জানান। এর মধ্যে তার কোম্পানির ডিএমডি পদে দুইজন পদচারী নেতাও রয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে তাদের মাধ্যমে তিনি টাকা পাচার করতে পারেন।

এদিকে জেকেজি গ্রম্নপের নামে আরিফ ও সাবরিনা দম্পত্তির নামে দায়েরকৃত মামলারও তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও জোন। সাবরিনার দ্বিতীয় দফা রিমান্ডের আজ শেষ দিন। শুক্রবার গভীর রাত পর্যন্ত তাকেও দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ সময় তিনি ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট দিয়ে আরিফ প্রতারণা করছেন বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তাকে জানান বলে দাবি করেন। দিন-তারিখ বলে দেওয়ার পর ওই দিনে সাবরিনার কললিস্ট সংগ্রহ করা হচ্ছে। আসলে তিনি ওই কর্মকর্তাকে জানিয়েছিলেন কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সাবরিনা দাবি করেন দুই দফা কল করে ওই কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানানোর পর তিনি চেপে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এ কারণে তিনি জেকেজির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তেজগাঁও জোনের ডিসি গোলাম মোস্তফা রাসেল কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

জানা গেছে, জেকেজির ভুয়া করোনা টেস্টের মামলায় সাবরিনাসহ আরও সাতজন আসামি রয়েছেন। অন্যরা হলেন- সাবরিনার স্বামী আরিফুল হক চৌধুরী, আরিফুলের ভগ্নিপতি সাঈদ, কর্মকর্তা-কর্মচারী হুমায়ুন কবির, তানজিনা পাটোয়ারী, মামুন ও বিপস্নব। গত ১২ জুলাই সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের তেজগাঁও ডিভিশনে আনা হলে পরে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সোমবার ঢাকার একটি আদালত সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে গত ২৩ জুন গ্রেপ্তার করা হয় আরিফ চৌধুরীকে। এ ঘটনার পর করোনা টেস্টের জাল সনদ সরবরাহ এবং টেস্ট ও চিকিৎসায় অতিরিক্ত টাকা আদায়সহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায়র্ যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় পরদিন ৭ জুলাই হাসপাতালটির উত্তরা শাখা এবং ৮ জুলাই মিরপুর শাখা সিলগালা করে দেয়র্ যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরপর একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদের নানা অপকর্মের ভয়াবহ সব তথ্য। মুখ খুলতে শুরু করেন ভুক্তভোগীরা। এছাড়া সাহেদকে ভয়ংকর প্রতারক উলেস্নখ করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে ২০১৬ সালে তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শককে চিঠি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তার বিরুদ্ধে পাওনাদারদের নিয়মিত নির্যাতনের অভিযোগও অঢেল। কেউ পাওনা টাকা চাইলে তাকে নানাভাবে হয়রানি ও অপদস্থ করতেন সাহেদ। এ পর্যন্ত তার নামে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৫৬টি মামলার সন্ধান পাওয়া গেছে।

Facebook Comments Box