ডায়রিয়ার প্রকোপ: ফুটন্ত পানি না খেয়ে বাড়ছে রোগ
নিজস্ব প্রতিবেদক: আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে আনা হয় মোহাম্মদপুরের পাশের শেখেরটেক এলাকার বাসিন্দা জিয়া মোল্লা। বাইরের খাবার খাওয়া হয় না তার। এর মধ্যেই মঙ্গলবার রাত থেকে পাতলা পায়খানা শুরু হয়।
পানি ফুটিয়ে পান করেন না জানিয়ে জিয়া বলেন, বেশিরভাগ সময় পানি ফুটানো হয় না। আমি ট্যাপের পানিই খাই। পানি থেকেই হইল কি না বুঝতে পারছি না।
এবার গরম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় দেখা দিয়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। সে কারণে আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইসিডিডিআর,বি) রোগীর সংখ্যাও হু হু করে বাড়ছে।
আইসিডিডিআর,বির তথ্যে দেখা গেছে, গত সোমবার ১২১৬, মঙ্গলবার ১২৭২, বুধবার ১২৩৩, গতকাল ইয়াওমুল খামীস (বৃহস্পতিবার) ১১৭৬, জুমুয়াবার ১১৩৮, শনিবার ১২৪৫, রোববার ১২৩০ জন, সোমবার ১৩৩৪, মঙ্গলবার ১৩১৭ জন রোগী ভর্তি হন। বুধবার বেলা ৪টা পর্যন্ত রোগী ভর্তি হয় ৭৭০ জন।
গত নয় দিনে ১১ হাজার ১৬১ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ২৪০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছে।
গরমের শুরুতে বরাবরই ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময়ে পানির চাহিদা বেড়ে যায়, বিপরীতে বিশুদ্ধ পানি সব সময় পাওয়া যায় না বলে পিপাসার্ত মানুষ দূষিত পানি পান করেন। ফলে পানিবাহিত এই রোগে এই সময়ে আক্রান্ত হয় বেশি।
তবে এবারের মতো একসঙ্গে এত বেশি রোগী আগে দেখা যায়নি বলে আইসিডিডিআর,বি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। রোগী সামলাতে বাইরে তাঁবু টানিয়েও দেওয়া হচ্ছে চিকিৎসা।
বুধবার আইডিডিআর,বিতে আসা অন্তত ১৫ জন রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বেশিরভাগই বাইরের খাবার খেয়েছেন। বাসার বাইরের খাবার খান না, পানি পান করেন না, তারপরও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কথা জানিয়েছেন কেউ কেউ।
মহাখালীর আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে এবার ডায়রিয়া রোগী অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।মহাখালীর আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে এবার ডায়রিয়া রোগী অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
শনির আখড়ার রিকশাচালক বশির আহমেদ ভর্তি হয়েছেন মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। বেশিরভাগ সময় বাইরেই খাওয়া-দাওয়া সারতে হয় তাকে।
“বাইরে নাস্তা করি, দুপুরে খাই। আর পানি তো বাইরেই খাইতে হয়। হেরা ভালো পানি দেয় না খারাপ পানি দেয় বুঝার তো কোনো সুযোগ নাই,” বলেন বশির।
রায়েরবাগের চা দোকানি ইব্রাহিম খলিলের ধারণা, পানি থেকেই তিনি ডায়রিয়া বাঁধিয়েছেন।
“বাড়িতে টিউবওয়েলের পানি ফুটাইয়া খাই। আর দোকানে থাকার সময় কলা-রুটি খাওয়ার পরে জারের পানি খাই। ওই পানির কারণেই হয়ত ডায়রিয়া হইছে।”
নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ডের একটি মাদ্রাসার ছাত্র শিব্বির আহমেদ আবার বুঝতে পারছেন না, কী কারণে তার ডায়রিয়া হয়েছে।
“আমি বাইরের খাবার কখনোই খাই না। আমাদের মাদ্রাসায় একসঙ্গে সবার রান্না হয়, সেখানেই খাই। আমাদের টিউবওয়েলের পানি আমরা সবাই খাই। খাবার ও পানি দূষিত হলে সবার ডায়রিয়া হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হল খালি আমার।”
ঢাকায় এখন যারা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত্ হচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই দূষিত পানি ও বাসি খাবারের কারণে বলে মনে করছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর।
তিনি বলেন, শুধু পানিকে দায়ী করলেও হবে না। ওয়াসার পানি খারাপ হলেও ভালোভাবে ফুটালে তা জীবাণুমুক্ত হয়ে যায়। এজন্য আমাদের সচেতন হতে হবে।
বাইরের বিশেষ করে খোলা খাবার একেবারে এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
মহাখালীর আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে ভর্তি ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীরা।মহাখালীর আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে ভর্তি ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীরা।
আইসিডিডিআর,বির হাসপাতাল প্রধান ডা. বাহারুল আলম বলেন, “যারা আক্রান্ত হচ্ছে তাদের বেশিরভাগই বাইরের খাবার বা পানীয় পান করছে অথবা অনিরাপদ পানি পান করছে। ঘর তৈরি খাবার খেয়ে ডায়রিয়া আক্রান্ত হলেও তা সংখ্যায় কম।
“ঘরের খাবার গ্রহণে করলে ডায়রিয়া কম হয় বলে আমার ধারণা। ঘরে একসঙ্গে তিন চারজনের জন্য রান্না করে। আর মায়েরা রান্নার বিষয়ে কেয়ারলেস হয় না। এজন্য আমরা সবসময় বলি বাইরে যে কোনো ধরনের খাবার পরিহার করতে। পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়ার জন্য মূলত দায়ী কিছু ব্যাকটেরিয়া।
ডা. বাহারুল বলেন, গরমের সময় সিগেলা, ই কোলাই, কলেরা (ভিব্রিও কলেরি) এবং শীতকালে রোটাভাইরাসের মাধ্যমে ডায়রিয়া ছড়ায়।
ঢাকা শহরে পানি সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান দাবি করছেন, তাদের পানিতে ডায়রিয়া বা কলেরার কোনো জীবাণু নেই।
বিভিন্ন স্থানে ওয়াসার লাইনেও দূষিত পানি পাওয়ার যে অভিযোগ আসছে, তা প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, ওয়াসার পানিতে কলেরার জীবাণু ছিল না, নাইও। গত এক মাস বা দুই মাস ধরে আমাদের পানি সরবরাহে কোনো ব্যত্যয় হয় নাই। ওয়াসার পানির মান যা ছিল, তাই আছে।















