ইসনাইন (সোমবার), ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

আগুনে পুড়েছে ঘর, পানিতে ডুবেছে সন্তান

নিউজ ডেস্ক:যদি কিছু বেঁচে থাকে সেই আশায় ছাই সরিয়ে চলছে সন্ধানরাত তখন সোয়া ১টা। সারা দিনের খাটুনি শেষে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে ছিলেন ভাসানটেকের আবুল ও জাহাঙ্গীর বস্তির শ্রমজীবী মানুষরা। এ সময় হঠাৎ আগুন লেগে যায়। ঘুমন্ত মানুষ আচমকা জেগেই দেখতে পায় চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা। ঘরের ভেতরে-বাইরে এমনকি বস্তিতে প্রবেশের একমাত্র সরু পথটিও আগুনে ছেয়ে গেছে। এ অবস্থায় জীবন বাঁচাতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খালে ঝাঁপ দেয় শত শত মানুষ। তবে আগুন থেকে পানিতে নেমেও বাঁচতে পারেনি তিন শিশু। মা-বাবার হাত ফসকে পানিতে ডুবে তাদের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে দুজনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এখনও নিখোঁজ একজন।

বুধবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাত সোয়া ১টার দিকে ভাসানটেকের জাহাঙ্গীর ও আবুলের বস্তিতে এ অগ্নিকাণ্ড ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ২১টি ইউনিট চেষ্টা চালিয়ে ভোররাতে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে সে পর্যন্ত বস্তির সব ঘর পুড়ে ছাই।

ভাসানটেকের সিআরপি ও বিআরপির মাঝখানে সরকারি জায়গায় পানির ওপর বাঁশ ও লোহার অ্যাঙ্গেল দিয়ে ঘর তুলে থাকতো দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ। অনেকে আবার ঘর তুলে ভাড়াও দিয়েছিলেন। ৬৫ জন ব্যক্তির প্রায় পৌনে চারশ’ ঘর ছিল এখানে। প্রতিটি কক্ষ ১৫শ’ করে ভাড়া দেওয়া হতো বলে জানা গেছে।

খালপাড়ে নিখোঁজ সন্তানদের জন্য স্বজনদের অপেক্ষাখাল থেকে দুই শিশুর লাশ উদ্ধার।আগুন থেকে বাঁচতে পরিবারের সদস্য ও সন্তানদের নিয়ে বস্তির পাশের খালে ঝাঁপ দেয় অধিকাংশ মানুষ। তবে নারী, শিশু ও বৃদ্ধাদের খাল পার করতে সমস্যা হয়। বাবা-মায়ের হাত ও কোল ফসকে পানিতে ঢুবে প্রাণ হারায় তিন শিশু। সন্তানহারা জননী রূপা আক্তার হারিয়েছেন আড়াই বছরের ছেলে তন্ময়কে। আগুনে যখন ঘর পুড়ছিল, তখন তিনি স্বামী ছনু মিয়া ও সন্তান তন্ময়কে নিয়ে খালে ঝাঁপ দেন। তখন মায়ের হাত ফসকে ডুবে যায় তন্ময়। অনেক খোঁজার পর সন্তানের লাশ পাননি তিনি। বৃহস্পতিবার দুপুরে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল তন্ময়ের লাশ উদ্ধার করে।

একইভাবে খাদিজা বেগম খাল সাঁতরে তিন মাসের মেয়ে ইয়াসমিনকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছিলেন। তখন কোল থেকে পড়ে হারিয়ে যায় শিশুটি। তারও লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। নিহত শিশুটির বাবার নাম নূর আলম। তাদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলায়।

ফায়ার সার্ভিসের বারিধারা স্টেশন ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমরা বেলা সাড়ে ১২টার দিকে শিশু দুটির লাশ উদ্ধার করি। এরপর ভাসানটেক পুলিশের কাছে লাশ হস্তান্তর করেছি।’
নুসরাত আক্তার (১২)। বিআরবি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাবা নজরুল ইসলাম রিকশাচালক। গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলায়। বস্তির আক্তারের ঘরে ভাড়া থাকতেন তারা। বাবা-মায়ের বড় সন্তান নুসরাত। আগুন লাগার পর বাবা-মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে সেও খালে ঝাঁপ দেয়। সে বাবার হাত ধরেছিল। কিন্তু খালে ঝাঁপিয়ে পড়া শত শত মানুষের হুড়োহুড়িতে নুসরাতের হাত ছুটে যায়। অন্যদিকে, পাঁচ বছরের ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে আর মেয়েকে খুঁজে পাননি নজরুল।

তিনি বলেন, ‘ছেলে-মেয়েকে নিয়ে যখন খালে ঝাঁপ দিয়েছি, তখন আমাদের সঙ্গে বস্তির অনেক লোক পানিতে নেমে পড়েছে। হুড়োহুড়িতে মেয়ের হাত ফসকে যায়। এরপর মেয়েকে আর খুঁজে পাইনি। মেয়ে সাঁতার জানতো না।’

ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল বৃহস্পতিবার দুপুরে যখন দুই শিশুর লাশ উদ্ধার করে তখন নজরুল ইসলাম তার মেয়ের জন্য খাল পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ডুবুরি দলটিকে সম্ভাব্য জায়গা দেখিয়ে দেন তিনি। কিন্তু কোথাও খোঁজ মেলেনি নুসরাতের।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহম্মেদ খান বলেন, ‘তিনজন শিশু নিখোঁজ ছিল। আমরা দুজনের লাশ উদ্ধার করেছি। বাকি শিশুটি উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের ডুবুরি দল খালে কাজ করবে।’

এদিকে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিতে পরিকল্পিতভাবে আগুন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বস্তির বাসিন্দা ও সেখানকার ৪৫টি ঘরের মালিক সফুরা বেগম বলেন, ‘৮-১০ দিন আগে কয়েকজন ব্যক্তি বস্তিতে আসে। তাদের চলাফেরা ছিল সন্দেহজনক। তারা পুরো বস্তি ঘুরে দেখে। এ সময় তারা বলেছিল, বস্তি ভেঙে দেওয়া হবে। তারা ঘুরে যাবার পরেই এ আগুন লাগলো। আমার বিশ্বাস ওরাই আগুন দিয়েছে।’

তবে ভাসানটেক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছাব্বির আহম্মেদ বলেন, ‘আমাদের কাছে এরকম কোনও তথ্য নেই। তারপরও আমরা ঘটনা তদন্ত করে দেখবো। কেউ এমন ঘটনা ঘটালে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
বস্তিতে প্রায় পৌনে চারশ’ টিনের ঘর ছিল। ডোবার ওপরে বাঁশ ও লোহার অ্যাঙ্গেল দিয়ে তৈরি করা ছোট ছোট ঘরগুলো পুড়ে ডোবার সঙ্গে মিশে গেছে। ছাই আর কয়লার ভেতরে মানুষ নিজেদের অবশিষ্ট সম্বলের খোঁজ করছেন। কেউ পোড়া টিন নিয়ে আসছেন, কেউ পোড়া থালাবাটি, লোহার খাট ছাইয়ের ভেতর থেকে টেনে তুলছেন। কেউ আবার ছাই সরিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে কিনা তার সন্ধান করছেন।

বস্তির বাসিন্দারা এখানে কেউ কেউ দশ বছর ধরেও আছেন। এত বছরের সঞ্চয় ও সংসার চোখের সামনেই পুড়েছে। কারো কারো নগদ টাকা, জমানো কিস্তির টাকা পুড়েছে। এমনই একজন হাবিবা। তিনি ময়মনসিংহ থেকে তিন বছর আগে ঢাকায় আসেন। এই বস্তিতে এসেই ১৫শ’ টাকায় একটি কক্ষ ভাড়া নেন। স্বামী ও সংসার নিয়ে তার ভালোই চলছিল। কিন্তু আগুনে তার সব শেষ। তিনি বলেন, ‘বাড়িতে টাকা পাঠাবো বলে ৯ হাজার টাকা জমিয়েছিলাম। সব পুড়েছে। বাসা থেকে এক কাপড়ে বের হয়ে গেছি।’

১৫-১৬ জন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা মিলে একটি সমবায় সমিতি করেছেন। তারা বস্তিতে ৮৭টির মতো ঘর বানিয়ে ভাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু সব পুড়ে এখন ছাই। তারা পরিবার নিয়ে এখানেই থাকতেন। এদের মধ্যে একজনের নাম মো. মোতালিব। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার চারটি ঘর ছিল। আমি পরিবার নিয়ে এখানেই থাকি। কিন্তু আগুন আমাদের পাশ দিয়েই আগে লেগেছে। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল। ঘর থেকে কিছু বের করতে পারিনি। আমরা সবাই পথে বসে গেছি।’

ভাসানটেক আবুলের বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহম্মেদ খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের সদর দফতরের উপ-পরিচালক নূর হাসানকে (অ্যাম্বুলেন্স) সভাপতি করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন সদস্য সচিব সহকারী পরিচালক সালেহ উদ্দিন, সদস্য মিরপুর জোনের প্রধান আনোয়ার হোসেন, মিরপুর ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র অফিসার কুতুব উদ্দিন ও ওয়্যার হাউজ ইন্সপেক্টর ওলিউল্লাহ।’

Facebook Comments Box