জুমুআ (শুক্রবার), ০৯ জুন ২০২৩

মার্জার হবে দুর্বল ব্যাংকগুলো

নিউজ ডেস্ক:বাংলাদেশ ব্যাংকব্যাংকিং খাতকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে মার্জার বা একীভূত করা হবে। দুর্বল ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে বাধ্যতামূলকভাবে একে অপরের সঙ্গে একীভূত হতে পারে সেজন্য একটি সুনির্দিষ্ট মার্জার নীতিমালা তৈরি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ড. মো. কবির আহমদের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, কমিটির সদস্য রয়েছেন ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ এবং অফসাইট সুপারভিশন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এই কমিটি একটি প্রতিবেদন তৈরি করে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের কাছে দাখিল করবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের ব্যাংকিং খাতকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই অংশ হিসেবে মার্জার নীতিমালা তৈরি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এদিকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) জরিপধর্মী এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭২ শতাংশ ব্যাংক কর্মকর্তা মনে করেন বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ ব্যাংক রয়েছে তা কমাতে হবে। ব্যাংকের সংখ্যা কমানোর ক্ষেত্রে অধিকাংশ কর্মকর্তাই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে মার্জার বা একীভূতকরণের পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তবে দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে আরেকটি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত না করার পরামর্শও দিয়েছেন তারা।

দেশের অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, অর্থনীতির আকারের তুলনায় দেশে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি। বর্তমানে দেশে ৫৮টি তফসিলি ব্যাংক কার্যক্রমে আছে। নতুন নতুন ব্যাংকও এ খাতে যুক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেওয়া ব্যাংকের সংখ্যা এখন ৬২।

গত এক দশক ধরে ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের চাপে পড়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত। খেলাপি ঋণের কারণে প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে ডজনখানেক ব্যাংক। ভালো পরিচালন মুনাফা করেও এই ব্যাংকগুলো শেয়ারহোল্ডারদের প্রত্যাশিত মুনাফা দিতে পারছে না।

এ পরিস্থিতিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূতকরণের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও বিভিন্ন সময় একীভূতকরণের কথা বলেছেন। ২০০৯ সালে শিল্প ঋণ সংস্থা ও শিল্প ব্যাংক একীভূত করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) গঠিত হয়। এরপর দেশের কোনও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ পথে হাঁটেনি।

এ প্রসঙ্গে বিআইবিএমের সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরী বলেন, ‘ব্যাংকগুলো নিজে থেকে এগিয়ে না এলে জোর করে একীভূত করে দেওয়ার ফল ভালো নাও হতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, শক্তিশালী ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকের দায়িত্ব নিতে চাইবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মালিক যেহেতু সরকার। এ ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত সরকার নিতে পারে। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে।’

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক আগেই দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূতকরণ বা অবসায়নের দরকার ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অভাবে সেটি সম্ভব হচ্ছে না।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘নীতিমালায় যা-ই থাকুক না কেন, ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্তটি আসতে হবে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে।’

জানা গেছে, একীভূতকরণের জন্য প্রাথমিকভাবে চারটি সরকারি ব্যাংকের একটি তালিকাও করেছে অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এগুলো হলো– বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক লিমিটেড। এছাড়া দেশে সরকারি-বেসরকারি-বিদেশি মিলিয়ে আর্থিক অবস্থার অবনতির তালিকায় রয়েছে আরও ১৩ ব্যাংক।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিদেশে মার্জারের ঘটনা অহরহ ঘটছে। সেখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বড় হওয়ার জন্য মার্জার করে থাকে। তবে আমাদের দেশে ছোট ব্যাংকগুলোর ধারণা, বড়দের সঙ্গে মার্জার হলে বড়রা তাদের খেয়ে ফেলবে।’ তবে তিনি মনে করেন, শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংককে যুক্ত করা গেলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।

ব্যাংকিং খাতে একীভূতকরণের কথা বলা আছে ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১’-তেও। আইনের ৪৯ (১) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, কোনও ব্যাংকের অনুরোধক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণ প্রস্তাবে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা রাখতে পারে। একইভাবে ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩’-এর বিধান অনুযায়ীও বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একীভূতকরণে সহায়তা করার ক্ষমতা রাখে। এই উভয় আইনের বিধান বাস্তবায়নে দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একীভূতকরণের জন্য ২০০৭ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

নীতিমালা অনুযায়ী, একটি ব্যাংক অন্য ব্যাংকের সঙ্গে, একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত হতে পারবে। যেকোনও ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কিংবা বিশেষ ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনও ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনসাপেক্ষে অধিগ্রহণ করতে পারবে। তবে যেকোনও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত আসতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ থেকে। এক্ষেত্রে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদনও থাকতে হবে।

Facebook Comments Box