ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে টানাপোড়েন
আরএফএন ডেস্কঃ পানিপ্রবাহের মাত্রা বিবেচনায় বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম নদ ব্রহ্মপুত্র। চীন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হলেও বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে এর অববাহিকাসংলগ্ন ভাটি অঞ্চল। মূলত জটিল ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য হুমকি বিবেচনায় এ উপেক্ষা ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। নদটির পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় কোনো চুক্তি হয়নি। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে ভাটিতে থাকা বাংলাদেশ।
ব্রহ্মপুত্র নদের পানিপ্রবাহ নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর নেভাল অ্যানালাইসিস (সিএনএ)। ‘ওয়াটার রিসোর্স কমপিটিশন ইন দ্য ব্রহ্মপুত্র রিভার বেসিন: চায়না, ইন্ডিয়া অ্যান্ড বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন বলছে, নদটির উজানে অববাহিকাসংলগ্ন অঞ্চল নিয়ে তুমুল প্রতিযোগিতা রয়েছে চীন ও ভারতের মধ্যে। ভাটির দেশ বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে দেশ দুটি। ব্রহ্মপুত্র নদে বিতর্কিত বাঁধ নির্মাণ কার্যক্রম ও পানির গতিপথ পরিবর্তনের পরিকল্পনা এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। দুই দেশের এ প্রতিযোগিতার কারণে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ।
গবেষণার অংশ হিসেবে নদটির অববাহিকাসংলগ্ন অঞ্চলের প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করে সিএনএ। এর পর জাতীয়, দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয়— সর্বস্তরের সহযোগিতা বিবেচনায় নিয়ে খাতসংশ্লিষ্টদের মতামত ও সুপারিশ আহ্বান করা হয়। এগুলোর ভিত্তিতে গবেষণা প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য সবচেয়ে বড় হুমকি তৈরি হয়েছে দেশটির সীমানার বাইরে থেকে। এর প্রভাব পড়বে দেশের অভ্যন্তরে। নদীতীরের ক্ষয়, বন্যা, পানিপ্রবাহ হ্রাস ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার মতো প্রতিক্রিয়া মোকাবেলা করতে হবে বাংলাদেশকে।
ব্রহ্মপুত্রের পানি ব্যবস্থাপনার পক্ষে সবচেয়ে সোচ্চার বাংলাদেশ। উজানে প্রতিবেশী দেশগুলোর কার্যক্রমের ফলে সামগ্রিকভাবে যে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা রয়েছে, তা থেকেই বাংলাদেশ এমন অবস্থান নিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া এর প্রভাব মোকাবেলার মতো সক্ষমতারও অভাব রয়েছে বাংলাদেশের।
চীন থেকে উত্পন্ন হয়ে ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ব্রহ্মপুত্র। নদীর কিছু অংশ ভুটানের মধ্য দিয়েও প্রবাহিত হয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বের ছয়টি রাজ্যের প্রায় ৫৭০ মাইলজুড়ে প্রবাহিত হয়েছে নদটি। এটির গতিপথসংলগ্ন রয়েছে চারটি দেশের ৫ লাখ ৮০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ৫০ শতাংশ চীন, ৩৪ শতাংশ ভারত, ৮ শতাংশ বাংলাদেশ ও সমপরিমাণ অঞ্চল ভুটানসংলগ্ন।
উত্পত্তিস্থল চীনে এ নদের নাম ইয়ারলুঙ সাঙপু। ভারতে এটি ব্রহ্মপুত্র ও সিয়াং নামে পরিচিত। আর বাংলাদেশে এটি প্রবেশ করার পর যমুনা হিসেবে প্রবাহিত হচ্ছে। এখান থেকে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিলিত হয়েছে এটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পানিনিরাপত্তা ইস্যুতে উদ্বেগের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এ নদ। কৌশলগত কারণে নদটি চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানত দেশটির জলবিদ্যুতের জন্য এর গুরুত্ব অনেক। এরই মধ্যে এ নদে একটি জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ করেছে চীন। পাশাপাশি আরো চারটি জলবিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে দেশটির। অন্যদিকে ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অরুণাচল প্রদেশে জলবিদ্যুৎ উত্পাদনের লক্ষ্যে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। তবে ভারতের এ পরিকল্পনায় উদ্বিগ্ন চীন। কারণ দুই দেশের মধ্যে এ অঞ্চলে সীমানা নিয়ে বিরোধ চলছে।
এ প্রসঙ্গে পানি ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বণিক বার্তাকে বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের বিষয়ে বাংলাদেশকে কথা বলতে হবে ভারতের সঙ্গে। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সীমান্ত নেই। আর চীনের অংশে বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাঁধ নির্মাণ হলে বাংলাদেশ পানি হারাবে কিনা, সেটা বুঝতে হলে আগে জানতে হবে চীন কী করছে। কারণ বিদ্যুৎ উত্পাদনের পর যে পানি বের হয়, সেটা পাকিস্তান মংলা বাঁধে ও ভারতের হিরাকুদ বাঁধ থেকে সেচের জন্য আলাদা সরিয়ে নেয়া হয়। এক্ষেত্রে দেখতে হবে চীন কী করছে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জেনেছি, চীন ব্রহ্মপুত্রে কোনো ব্যারাজ তৈরি করেনি, বাঁধ তৈরি করেছে। ব্যারাজ যেহেতু নয়, চীনের দিক থেকে ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহারের কোনো শঙ্কা নেই।
চীনের দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এ নদে জলবিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করতে পারলে বিরোধপূর্ণ অঞ্চলটিতে ভারতের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ আরো শক্তিশালী হবে। একই সঙ্গে সীমানাবিরোধ নিষ্পত্তির আলোচনাকে এটি আরো জটিল করে তুলবে। ফলে ভারত ও চীনের মধ্যকার উত্তেজনা আরো বাড়তে পারে।
ভারতের সাতটি বড় নদ-নদীর অন্যতম ব্রহ্মপুত্র। দেশটিতে এ নদের রাজনৈতিক গুরুত্ব ব্যাপক। নদের ওপর অধিকার ধরে রাখা শুধু চীনের সঙ্গে বিবদমান ভূমিতে ভারতের বিদ্যমান নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করবে না। সেই সঙ্গে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা ও ভূমিক্ষয় ব্যবস্থাপনায়ও ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে ব্রহ্মপুত্রের।
ভারত অংশ প্রসঙ্গে ড. আইনুন নিশাত বলেন, দেশটি অরুণাচল, আসাম, মেঘালয় ও মিজোরামে অনেক জলাধার তৈরি করছে। সেগুলোর বিষয়েও আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। এজন্য ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশকে কথা বলতে হবে, উজানের খবর নিতে হবে। বাংলাদেশ-ভারত পানি সমস্যা সমাধানে যৌথ নদী কমিশনকেও আরো ভূমিকা রাখতে হবে। যত দূর জানি, গত কয়েক বছরে ব্রহ্মপুত্র নদ নিয়ে যৌথ কমিশন ভারতের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি।
ব্রহ্মপুত্র ঘিরে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ঠেকাতে বেশকিছু সুপারিশও করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে ভারত ও চীনের মধ্যে জলানুসন্ধানভিত্তিক তথ্য আদান-প্রদান বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। চীনকে বন্যাকালীন প্রকৃত তথ্য, সারা বছরের নদীপ্রবাহের তথ্য আদান-প্রদান করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ভারতকেও এসব তথ্য দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বহুপক্ষীয় সহযোগিতার অংশ হিসেবে কারিগরি জ্ঞানবিনিময় ও আস্থার সম্পর্ক তৈরির মতো বিষয়গুলোতেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কতগুলো বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে, ভারতের উচিত তা প্রকাশ করা। গুরুত্ব দিতে হবে ভারত, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রতি বছর ত্রিদেশীয় সংলাপ অনুষ্ঠানের বিষয়েও।