ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধে সময় পাবেন ১০ বছর!
নিউজ ডেস্ক:
বাংলাদেশ ব্যাংকবাংলাদেশ ব্যাংকের আনুকূল্য পাওয়া কিছু ব্যবসায়ীর জন্য শিথিল করা হচ্ছে ঋণ পুনঃতফসিল নীতিমালা। ব্যাংকগুলো তাদের পছন্দের ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ১০ বছর পর্যন্ত বাড়াতে পারবেন। অর্থাৎ ব্যাংকের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য পুনঃতফসিল করা ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ ১০ বছর করে সময় পাবেন। একইভাবে তারা আগের চেয়ে কম ডাউন পেমেন্ট দিয়েই ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, খেলাপি ঋণ কমানোর অংশ হিসেবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। গত এক বছরে খেলাপি বেড়েছে ১৯ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০১৭ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা।
সূত্র বলছে, এই খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যে সরকারের গঠিত কমিটির সুপারিশের আলোকে ঋণ পুনঃতফসিল নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি কমিটি কাজ করছে। সরকারের গঠন করা কমিটির প্রধান ছিলেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত।
এ প্রসঙ্গে ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত নিয়ে সুপারিশটি এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে একটি মেয়াদি ঋণ সর্বোচ্চ (তিনবার) ৩ বছরের জন্য পুনঃতফসিল করতে পারে ব্যাংকগুলো। নতুন নীতিমালায় সর্বোচ্চ ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়ার একটি প্রস্তাব আমরা দিয়েছি। তবে এটা হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার জারির পর।’
জানা গেছে, বর্তমানে একটি মেয়াদি ঋণ পুনঃতফসিল করতে প্রথমবার ডাউন পেমেন্ট হিসেবে মোট বকেয়ার ১০ শতাংশ, দ্বিতীয়বার ২০ শতাংশ এবং তৃতীয়বার ৩০ শতাংশ দিতে হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ সুবিধায় পুনর্গঠিত ঋণ পুনঃতফসিল করতে ডাউন পেমেন্ট দিতে হয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিশেষ সুবিধায় পুনর্গঠিত ঋণও খেলাপি হয়ে পড়েছে। এই সব ঋণকে নতুন করে পুনঃতফসিল সুবিধা দিতে চায় সরকার। যদিও এর আগে বেশ কয়েক ধরনের ছাড় দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন করা হলেও খেলাপি ঋণ আদায় তেমন হয়নি, বরং বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, ‘ঋণখেলাপিরা যেভাবে ব্যাংক খাতে জেঁকে বসেছে, তাতে মনে হচ্ছে ঋণখেলাপিরা আমৃত্যু ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করলেও চলবে। এ অবস্থায় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক অঙ্গীকার জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।’
এদিকে খেলাপিদের সুবিধা দিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণও আগের চেয়ে ছয় মাস বাড়ানোর চিন্তাভাবনা চলছে। বর্তমানে কোনও ঋণ তিন মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে সাব-স্ট্যান্ডার্ড, ছয় মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে সন্দেহজনক এবং নয় মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে মন্দমানে খেলাপি হিসেবে শ্রেণিকরণ করা হয়। অচিরেই ছয় মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া ঋণকে সাব-স্ট্যান্ডার্ড, ১২ মাস মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ সন্দেহজনক এবং দেড় বছর মেয়াদোত্তীর্ণ হলে তা মন্দমানে শ্রেণিকরণ করা হবে।
২০১৫ সালে বিশেষ বিবেচনায় ডাউন পেমেন্ট ও মেয়াদের শর্ত শিথিল করে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৯৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। শুধু গত বছর পুনঃতফসিল করা হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকার ঋণ। এর মধ্যে শেষ তিন মাসেই পুনঃতফসিল হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-২০১৭ এই পাঁচ বছরে ব্যাংকগুলো থেকে ৮৪ হাজার ৫০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা পেয়েছেন খেলাপি গ্রাহকরা।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে জারি করা নীতিমালায় সুদহার কমানো, পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধি, ডাউন পেমেন্টের শর্ত শিথিলসহ নানা সুবিধা পায় পাঁচশ’ কোটি টাকার উপরে ঋণ নেওয়া ১১টি ব্যবসায়ী গ্রুপ। ওই সময় তারা ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করে। পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠিত ঋণের টাকা ফেরত না দেওয়ায় সুদে-আসলে ব্যাংকগুলোর পাওনার পরিমাণ ১৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংকের টাকা ফেরত না দেওয়ার সংস্কৃতি বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যেই বেশি। তারা ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিয়ে পুনঃতফসিলের সুযোগ খোঁজে। আবার ব্যালেন্সশিটে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে ব্যাংকগুলো নিজেরাও ঢালাওভাবে বড় কিছু গ্রাহককে ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা দেয়। দেখা যায় কোনও কোনও ঋণ হয়তো ১০ বারও পুনঃতফসিল হয়েছে।’তিনি উল্লেখ করেন, ‘ব্যাংক খাতে যতদিন সুশাসন আসবে না, ততদিন এর কোনও সুরাহা হবে না।’