বঙ্গোপসাগরে কার্গো বিমান বিধ্বস্ত
কক্সবাজারে গতকাল বুধবার সকালে ইউক্রেনের একটি কার্গো বিমান বিধ্বস্ত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে পাইলটসহ তিনজনের প্রাণহানি ঘটেছে। দুর্ঘটনায় আহত একজনের অবস্থা গুরুতর। তাঁকে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল থেকে উন্নত চিকিত্সার জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। হতাহত ক্রুদের সবাই ইউক্রেনের বাসিন্দা বলে জানা গেছে। দুর্ঘটনায় নিহতরা হচ্ছেন ক্যাপ্টেন মুরাদ গাফরভ, কো-পাইলট ইভান পেট্র এবং ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার কুলিশ আন্দ্রে। আহত নেভিগেটরের নাম ভ্লুবিমার কুলতুনভ। তাঁদের সবার বয়স ৪০ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। গতকাল সকাল ৯টার দিকে কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে চিংড়ি পোনার চালান নিয়ে কার্গো বিমানটি যশোর বিমানবন্দরের উদ্দেশে উড্ডয়নের ১৫-২০ মিনিটের মাথায় বিধ্বস্ত হয়। ঘটনা তদন্তের জন্য গতকালই সিভিল এভিয়েশনের দুর্ঘটনা তদন্ত দলের (এআইজি) প্রধান ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন এম রহমতুল্লাহর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল কক্সবাজারে এসে পৌঁছায়। এসেই দলটি তদন্তকাজ শুরু করে। দুর্ঘটনাস্থল নাজিরারটেক সৈকতের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, ওড়ার সময় বিমানটির বাম দিকের পাখাটি অচল দেখা গেছে। বিমানবন্দরের দিক থেকে এটি বাঁ দিকে কাত হয়ে অত্যন্ত ধীর গতিতে নাজিরারটেক সৈকতের আধা কিলোমিটার দূরে এবং সোনাদিয়া দ্বীপের দক্ষিণে সাগরে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়। এ সময় সাগরের ওই জায়গার আশপাশে মাছ ধরার অনেক নৌকা ছিল। তবে বিমানটি যেখানে বিধ্বস্ত হয়, সেখানটায় কোনো নৌকা ছিল না। বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে সাগরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নৌকাগুলো সেখানে ছুটে গিয়ে জেলেরাই উদ্ধার অভিযানে নেমে পড়ে। এমনকি জেলেরাই বিধ্বস্ত বিমান থেকে নেভিগেটর ভ্লুবিমার কুলতুনভ এবং ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার কুলিশ আন্দ্রেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে। পরে সেখান থেকে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আহতদের দ্রুত নিয়ে যান জেলা সদর হাসপাতালে। হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক কুলিশ আন্দ্রেকে মৃত ঘোষণা করেন। আর আহত ভ্লুবিমার কুলতুনভকে উন্নত চিকিত্সার জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক সাধন কুমার মহন্ত গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গতকাল সকাল ৯টার দিকে চিংড়ির পোনা বোঝাই কার্গো বিমানটি কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে যশোরের উদ্দেশে উড্ডয়ন করে। কিন্তু এর কয়েক মিনিট পরই পাইলট বাঁ ইঞ্জিন বন্ধ বলে টাওয়ারে জরুরি রেডিও বার্তা পাঠিয়ে ফের অবতরণের কথা জানান।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা এ রকম জরুরি বার্তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সব কাজকর্ম বন্ধ ঘোষণা করে দিই। বিমানটি দক্ষিণদিকে উড্ডয়ন করেছিল। আমরা দেখতে পাই, বিমানটি রানওয়েতে অবতরণের জন্য ফিরে আসতেই আবার কাত হয়ে পশ্চিমে সাগরের দিকে চলতে থাকে। বিমানবন্দর থেকে আনুমানিক ১০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সাগরে গিয়ে শেষ পর্যন্ত এটি বিধ্বস্ত হয়।’ গতকাল বিকেলে নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ সদস্যরা সাগর থেকে বিধ্বস্ত বিমানের ভগ্নাংশ এবং নিহত অন্য দুজনের লাশ উদ্ধার করেন। নিহত ক্যাপ্টেন মুরাদ গাফরভ ও কো-পাইলট ইভান পেট্র—দুজনই সিটবেল্ট বাঁধা অবস্থায় বিমানের ককপিটে ছিলেন। সাগরের তলদেশে বিমানের ধ্বংসাবশেষ থেকে তাঁদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। কক্সবাজারের এমপি আশেক উল্লাহ রফিক কালের কণ্ঠকে জানান, নিহত তিন ইউক্রেনবাসীর মরদেহ ময়নাতদন্ত করে স্বদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। বাংলাদেশে ইউক্রেনের এই বিধ্বস্ত বিমানটিসহ দুটি কার্গো বিমান ভাড়া করে আনে ট্রু এভিয়েশন লি. নামের একটি বেসরকারি কম্পানি। এই কম্পানির ব্যবস্থাপক হাশমত জাহান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশে আনা ইউক্রেনের কার্গো বিমানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে টিপটপ বিমান ছিল এটি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সবচেয়ে ভালো বিমানটিই দুর্ঘটনায় পড়েছে।’ তিনি জানান, কক্সবাজার থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা মূল্যের ৭০০ কার্টন চিংড়ি পোনা বিমানটিতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল যশোরে। দুর্ঘটনার সময় তিনিও বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন জানিয়ে বলেন, এটি নেহায়েত একটি দুর্ঘটনা। এখানে কারো হাত নেই। হতাহতের শিকার হওয়া ক্রুরা তাঁদের বিমান নিয়ে বাংলাদেশে আসেন গত ৮ জানুয়ারি। ছয় মাসের চুক্তিতে তাঁরা আসেন। আগামী জুনে তাঁদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কক্সবাজারের মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের এমপি আশেক উল্লাহ রফিক দীর্ঘদিন ধরে চিংড়ি পোনার ব্যবসায় জড়িত। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, নব্বইয়ের দশকে কক্সবাজারে চিংড়ি পোনার হ্যাচারির যাত্রা শুরু হয়। পরে এসব হ্যাচারিতে প্রচুর পরিমাণের পোনা উত্পাদন হতে থাকে। আর এসব হ্যাচারির পোনা চাষ হয় খুলনা উপকূলের ঘেরে। তিনি আরো বলেন, চিংড়ি পোনার মৃত্যু রোধে স্বল্প সময়ে পরিবহন সুবিধার জন্য এয়ার পারাবাত নামের একটি প্রতিষ্ঠান যাত্রীবাহী বিমানকে কার্গো বানিয়ে শুরু করেছিল পোনা পরিবহন। পরে ১৯৯৭ সালে ইউক্রেন থেকে ভাড়ায় কার্গো বিমান আনার কাজ শুরু হয়। ২০০০ সালের দিকে চিংড়ি পোনার চাহিদা বেশ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিমানের সংখ্যা বেড়ে হয় ১১টি। এই ১১টি বিমানেই কক্সবাজার থেকে যশোরে পোনা পরিবহন করা হতো। বর্তমানে পোনার চাহিদা কমে যাওয়ায় কার্গো বিমানের সংখ্যাও কমে আটটিতে দাঁড়ায়। কক্সবাজারে এখন ৩০টি হ্যাচারিতে চিংড়ির পোনা উত্পাদন হচ্ছে। নৌবাহিনীর অভিযানে বিধ্বস্ত বিমান ও হতাহত ক্রুদের উদ্ধার গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, নৌবাহিনীর উদ্ধার অভিযানের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত বেসামরিক কার্গো বিমানের হতাহত ক্রুদের উদ্ধার করা হয়েছে। দুর্ঘটনার পরপরই জরুরি ভিত্তিতে নৌবাহিনীর দুটি জাহাজ বানৌজা অপরাজেয় ও বানৌজা অতন্দ্র একটি ল্যান্ডিং ক্রাফট, একটি মেরিটাইম পেট্রল এয়ারক্রাফট, নৌবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের তিনটি ডিফেন্ডার ক্লাস বোট, জাহাজের দুটি বোট, চ্যানেল রাইডার অভিযানে নিয়োজিত নৌবাহিনীর অন্য একটি বোট এবং নৌবাহিনীর তিনটি ডুবুরি দল উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। এর আগে নৌবাহিনীর মেরিটাইম পেট্রল এয়ারক্রাফট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আকাশে টহল দিতে থাকে এবং বিধ্বস্ত বিমানের অবস্থান শনাক্ত করে। পরবর্তী সময়ে নৌবাহিনীর এয়ারক্রাফট থেকে জাহাজে পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে ঘটনাস্থলে নৌবাহিনীর জাহাজ, বোট ও ডুবুরি দল এবং কোস্ট গার্ডের সদস্যরা দুপুরের মধ্যে একজনকে জীবিত এবং তিনজনকে মৃত উদ্ধার করেন। উদ্ধারকৃত সবাই ইউক্রেনের নাগরিক।