তেলের দাম কমায় কতটা লাভবান হলো জনগন?

ভোক্তা অধিকারকর্মী ও অর্থনীতিবিদরা হিসাব করে দেখিয়েছেন, তেলের দাম কমায় উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং পরিবহন মালিকরাই লাভবান হচ্ছেন।
গত ২৫ এপ্রিল প্রথম প্রহর থেকে ডিজেল-কেরোসিনের দাম লিটারে তিন টাকা, পেট্রোল-অকটেনের দাম লিটারে ১০ টাকা করে কমানো হয়েছে। এর আগে ৩১ মার্চ ফার্নেস অয়েলের দাম কমেছে লিটারে ১৮ টাকা। বলা হচ্ছে, এতে অর্থনীতির হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দশমিক ৩ শতাংশ, তৈরি পোশাকের রপ্তানি দশমিক ৪ শতাংশ বাড়তে পারে। ভোক্তা চাহিদা বাড়তে পারে দশমিক ৬ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি দশমিক ২ শতাংশ কমে আসতে পারে।
কিন্তু তেলের দাম কমায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মুনাফা যে পরিমাণ কমবে, সেই লাভ যাবে তাদের পকেটে, যারা সরাসরি ওই তেলে কিনবেন। অর্থাৎ বাস, গাড়ি বা সেচপাম্প মালিকরাই সেই লাভ পাবেন, নিম্নবিত্তের ভোক্তারা নন।
রেল, লঞ্চ, বাসের মতো পরিবহন ও কৃষির সেচযন্ত্র ডিজেলে চলে। এ ধরনের যানবাহন বা যন্ত্রের ওপর যারা নির্ভরশীল, অথবা যারা কেরোসিন ব্যবহার করেন, তাদের ক্ষেত্রে তেলের খরচ কমেছে চার শতাংশের মতো।
অন্যদিকে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারের মতো ব্যক্তি মালিকানাধিন সৌখিন যানবাহনে পেট্রোল ও অকটেন ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশও ব্যক্তিগত গাড়ি বা যানবাহনের মালিক নন। এই উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য তেলের খরচ কমছে দশ শতাংশের মতো। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশনের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মুজিব উদ্দিন আহমেদ বলেন, “এভাবে জ্বালানির দাম কমানোর ফলে তার সুফল দেশের সব নাগরিকের কাছে না পৌঁছে গুটিকয়েক মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এমন কিছু মানুষ এর লাভ পাবেন, যারা আদৌ এর মুখাপেক্ষি ছিলেন না।”
তিনি হিসাব করে দেখান, ডিজেলচালিত যানবাহনে লিটারে মাত্র ৩ টাকা দাম কমানোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভাড়া কমাতে চাইলে তা হবে কয়েক পয়সা।
“আজকাল তো আর বাজারে পয়সা নেই। দাম কমার সুবিধাটা যাত্রী পাবেন না। আর পরিবহন মালিকরা একটু একটু করে অনেক লাভের মালিক হবেন। পূরো সিনারিওটা খুবই বিব্রতকর।”
একুশে পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুদ্দিন ফরহাদ জানান, তাদের ঢাকা-নোয়াখালী রুটে একটি বাসের যাওয়া-আসা মিলিয়ে একশ লিটার ডিজেল খরচ হয়, যার দাম আগে ছিল ৬ হাজার ৮০০ টাকা। তেলের দাম কমার পর এখন ৩০০ টাকার মতো সাশ্রয় হচ্ছে। এই তিনশ টাকা দুই যাত্রার ৮০ জন যাত্রীর মধ্যে ভাগ করে দিলে প্রতি টিকেটে তিন টাকা ৭৫ পয়সা করে কমানো সম্ভব।
“ভিক্ষুককে পাঁচ টাকার নিচে দিতে গেলে এখন তারা চোখ কড়মড় করে। তেলের দাম কমায় সবাই ভাবছে পরিবহনের ভাড়াও হয়তো কমবে। কিন্তু পরিমাণটা হতাশাজনক,” বলেন ফরহাদ। একুশে পরিবহনে ঢাকা থেকে নোয়াখালী যেতে এসি কোচের টিকিট ৪০০ টাকা, নন এসি ৩৫০ টাকা বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, তেলের দাম কমার সুফল যাত্রীরা না পেলেও পরিবহন মালিকরা ঠিকই অল্প অল্প করে বড় অংকের মুনাফা পাবেন।
তার অভিযোগ, পরিবহন মালিকচক্রকে ভাড়া না কমানোর সুযোগ করে দিতেই সরকারের এই ‘দাম কমানোর ছল’।
“মালিক বলবেন, লিটারে মাত্র ৩ টাকা হিসাবে যে হারে ভাড়া কমে, তা যাত্রীদের হাতে দেওয়ার মতো নয়। বাস্তবেও আমরা তাই দেখতে পাচ্ছি। ১০-২০ টাকা কমালেও আমরা বার্গেইনিংয়ে যেতে পারতাম।”
মালিকদের লাভের চিত্র তুলে ধরে মোজাম্মেল বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে যে গাড়ি চালাতে আগে প্রতিবার ১৩০০ টাকা জ্বালানি খরচ হতো, এখন তা এক হাজার টাকায় নেমে এলো। এভাবে দৈনিক এক হাজার টাকা করে বেশি পাওয়া গেলে যার দশটা গাড়ি আছে তিনি কয়েক মাসের মধ্যে আরেকটা গাড়ির মালিক হতে পারবেন।
কোন তেলের চাহিদা কত?
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মার্কেটিং ও ডিস্ট্রিবিউশন বিভাগের মহা ব্যবস্থাপক আবু হানিফ জানান, বর্তমানে জ্বালানি তেলের দৈনিক চাহিদা-
পেট্রোল: ৩০০ মেট্রিক টন
অকটেন: ৩২০ মেট্রিক টন
ডিজেল: সাড়ে নয় হাজার থেকে ১০ হাজার মেট্রিক টন
কেরোসিন: ৩৫০ মেট্রিক টন
যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি পেট্রোল বা অকটেনে চলে, তারাও দাম কমানোর কারণে লাভবান হবেন। লিটারে দশ টাকা কম নেওয়ায় বিপিসির যে মুনাফা কমবে, তার পুরোটাই যাবে ধনী বা উচ্চ মধ্যবিত্ত গাড়ি মালিকদের পকেটে। রেল ভাড়া প্রসঙ্গে মোজাম্মেল বলেন, “আমরা জেনেছি, ডিজেলের দাম কমার ফলে রেলে প্রতিদিন লাখ টাকার মতো সাশ্রয় হবে। কিন্তু তারা এখনও লোকসানের কথা শোনাচ্ছে।”
বাংলাদেশ রেলওয়ের যান্ত্রিক বিভাগের যুগ্ম মহাপরিচালক মতিন চৌধুরী জানান, পূর্ব-পশ্চিম মিলিয়ে বছরে তাদের সাড়ে চার কোটি লিটার জ্বালানি খরচ হয়। এই হিসেবে, ডিজেলের দাম কমায় প্রতিদিন রেলের তেল খরচ থেকে বাঁচবে প্রায় চার লাখ টাকা। তবে তেলের দামের কারণে ট্রেনের ভাড়া কমার কোনো সম্ভাবনা আপাতত রেল কর্মকর্তারা দেখছেন না।
জনগণের ‘স্বার্থের দিকে তাকিয়ে’ প্রতি লিটার ডিজেলের দাম আরও কমানোর দাবি জানিয়ে যাত্রীকল্যাণ সমিতির মোজাম্মেল বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তুলনা করলে সরকার এখনও প্রতি লিটার ডিজেলে ২০-২৫ টাকা করে লাভ করছে। অথচ এসব খাত নিয়ে সরকারের ব্যবসা করার কথা নয়, জনগণের মধ্যে সুফলের সুষ্ঠু বণ্টন করার কথা।”
দীর্ঘ দিনের দাবির পর সরকার তেলের দাম কমালেও তাতে সারা দেশে পাঁচ লাখ যানবাহন ও দুই লাখ নৌযানের মালিকরাই কেবল লাভবান বলে বলে মন্তব্য করেন তিনি।