কথায় কথায় এই শিক্ষার্থীদের টিসি দেয়ার হুমকী

‘আমরা জিম্মি হয়ে গেছি। কথায় কথায় এই স্কুলে শিক্ষার্থীদের টিসি দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। এখানে সহজে মেলে টিসি আর হুমকি।’
রাজধানীর উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক ক্ষুব্ধ কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন। তিনিসহ প্রায় ৫০ জন অভিভাবক আজ সোমবার সকালে বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে এসে ব্যর্থ হয়েছেন। পরে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগে অভিভাবকেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির এক শিক্ষকের বিচার চাইতে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁদের বিদ্যালয়ের মূল ফটকের ভেতরেই ঢুকতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ।
বিদ্যালয়ের মূল ফটকের বাইরে অপেক্ষমাণ বেশ কয়েকজন অভিভাবক প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর সবাই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। কারণ, বক্তব্যের জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁদের সন্তানদের টিসি দিয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা ওই অভিভাবকদের।
একজন অভিভাবকের অভিযোগ, কোনো বিষয় নিয়েই তাঁরা এই স্কুলের অধ্যক্ষের সঙ্গে কখনোই কথা বলার সুযোগ পান না।
অপর একজন অভিভাবক বলেন, ‘কোনো দিন হয়তো আমার ছেলেকে লাশ করে ফেলে দেবে। কিন্তু আমরা কিছু বলতে পারব না।’
আরেকজন অভিভাবক বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করতে চাই, অভিযোগ ওঠা শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে স্কুল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বিচার পাওয়া নিয়ে আমাদের সংশয় আছে।’
অভিভাবকেরা জানান, আজ তাঁরা একটি দরখাস্ত নিয়ে এসেছিলেন। এতে শিক্ষার্থী মারধরের ঘটনায় উদ্বেগ জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে অভিযোগ ওঠা শিক্ষকের বিচার দাবি করা হয়েছে।
অভিভাবকদের অনুরোধে আজ বিদ্যালয়ের সামনে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল বারাকাত। তিনি বলেন, যে শিক্ষার্থীকে মারা হয়েছে, সে অপ্রাপ্তবয়স্ক। এটা শিক্ষকসুলভ আচরণ নয়। এক শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনায় অন্য শিক্ষার্থীরা যে মানসিক বৈকল্যে ভুগবে না, তার নিশ্চয়তা নেই।
শিক্ষার্থীকে মারধর করার অভিযোগ ওঠা শিক্ষকের নাম জাওশেদ আলম।
বিদ্যালয়ের কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থী উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির কাকাতুয়া শাখায় পড়ে। ঘটনার দিন ১৩ এপ্রিল সে অঙ্কের শিক্ষক জাকির হোসেনের ক্লাস করছিল। এ সময় শিক্ষক জাওশেদ আলম তাকে ক্লাস থেকে ডেকে এনে মারধর করেন।
মারধরের শিকার শিক্ষার্থীর বাবা গতকাল রোববার বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
এক শিক্ষার্থীকে শিক্ষক জাওশেদ আলমের মারধর করার বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ উম্মে সালেমা বেগম। আজ এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ওই শিক্ষকের পক্ষে সাফাই করেছেন অধ্যক্ষ। তিনি বলেন, একজন জনপ্রিয় শিক্ষক কেন একজন ছাত্রকে মারধর করেছেন, সেটাও দেখতে হবে। শিক্ষার্থীরা ওই শিক্ষককে যে নামে ডাকে, তা কোনো ভদ্র সমাজে বলা সম্ভব নয়।
অভিভাবকদের সাক্ষাৎ না দেওয়ার বিষয়ে নিজের ব্যস্ততার ওজর দেখান উম্মে সালেমা বেগম। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। এ বিষয়ে তারাই সিদ্ধান্ত নেবে।
তদন্ত চলাকালে অভিযোগ ওঠা শিক্ষক কেন ক্লাস নিচ্ছেন—এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ বলেন, তিনি ভালো শিক্ষক। তিনি ক্লাস না নিলে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হবে।
কথায় কথায় শিক্ষার্থীদের টিসি ও হুমকি দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে উল্টো অভিযোগকারীর নাম-পরিচয় জানতে চান অধ্যক্ষ।
নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীর স্বজন প্রথম আলোকে বলেন, অষ্টম শ্রেণির ক্লাস হয় ভবনের চতুর্থ তলায়। তাঁরা জানতে পেরেছেন, চতুর্থ তলার করিডরে এক দফা ও পরে ষষ্ঠ তলায় নিয়ে আরেক দফা ছেলেকে মারধর করা হয়। অন্য শিক্ষার্থীরা শিক্ষক জাওশেদ আলমকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে শোনে। তিনি বলছিলেন, ‘অ্যাই, তুই আমার নামে কী বলেছিস, বল?’ তিনি ছেলেটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কানে, মাথার পেছনে অনবরত থাপ্পড় দিতে থাকেন। একসময় অন্য ক্লাস থেকে শিক্ষকেরা বেরিয়ে এলে তিনি ছেলেটিকে চুল ধরে টেনে ষষ্ঠ তলায় নিয়ে যান এবং মারতে থাকেন। একপর্যায়ে ছেলেটির কানের পেছন থেকে রক্ত পড়তে শুরু করে। ওই স্বজন জানান, ছেলেকে তাঁরা একটি স্থানীয় ক্লিনিকে নিয়ে যান। চিকিৎসকের পরামর্শে সেখানে তার সিটি স্ক্যান করানো হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে আপাতত সে বিদ্যালয়ে যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে অভিযুক্ত শিক্ষক জাওশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যখন করিডর দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন হঠাৎ ও (শিক্ষার্থী) আমাকে সিএনজি বলে ডাক দেয়। বাচ্চারাই আমাকে এ কথা বলে। পরে আমি তাকে ডেকে এনে হালকা চড়-থাপ্পড় দিয়েছি। তাকে জিজ্ঞেস করেছি, কেন সে আমাকে সিএনজি বলে ডাকল, ক্লাসে আর কে কে আমাকে এই নামে ডাকে। সে কিছুই বলতে রাজি হয়নি। বিষয়টিকে যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, এটা সে রকম গুরুতর কিছু নয়।’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে ২০১০ সালের ৯ আগস্ট সরকার একটি পরিপত্র জারি করে। সর্বশেষ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে ৩২ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের করণীয় ঠিক করতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়।