উদ্ভাবন: প্রতি শীষে এক হাজার থেকে ১১ শ’ দানা।
আর এফ এন নিউজ: এবার কৃষক পর্যায়ে উদ্ভাবিত হলো সুপার বাম্পার ফলনশীল জাত ‘ফাইন রাইস’। নতুন এ জাতের ধানের ফলন সাধারণ বিআর-২৮ জাতের ধানের থেকেও ৬ গুণ বেশি। অর্থাৎ একরে ফলন প্রায় ১৩০ মণ। বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার বেতাগা ইউনিয়নের চাকুলী গ্রামের কৃষক লেবুয়াত শেখ এই ধান উদ্ভাবন করেছেন। হটাৎ পেয়ে যাওয়া ধানের তিনটি ছড়া থেকে মাত্র দুই বছরে প্রায় এক শ’ মণ ধান ফলিয়ে তিনি এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়ায় রীতিমতো ভিড় জমেছে তার বাড়িতে। এখন বিভিন্ন জেলা থেকে শতশত কৃষক উচ্চ ফলনশীল জাতের এই ধানের বীজ সংগ্রহ করতে আসছেন তার বাড়িতে। কেজি প্রতি ৪ শ’ টাকা দরে এ ধানের বীজ স্থানীয় পর্যায়ে বিক্রিও করছেন লেবুয়াত শেখ।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এটি কৃষক পর্যায়ে উদ্ভাবিত একটি নতুন জাতের ‘ফাইন রাইস’ প্রজাতির ধান। এর ফলন সাধারণ বিআর-২৮ জাতের ধানের থেকেও ৬ গুণ বেশি। নতুন এই জাতের ধান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে পারলে জনসংখ্যা বাড়লেও দেশে আর খাদ্যাভাব থাকবে না।
মাত্র তিনটি ছড়া (শীষ) থেকে দুই বছরে প্রায় এক শ’ মণ ধান ফলেছে। বিস্ময়কর জাতের এই ধান নিয়ে শুধু সাধারণ কৃষক নয়, উৎসুক বাগেরহাটের কৃষি বিভাগও। এ ধানের ব্যাপারে স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সোলায়মান আলী জানিয়েছেন, প্রথমে তারা কৃষক লেবুয়াত শেখের ধানের ক্ষেতে গিয়ে ধানের নমুনা দেখে অবাক হয়ে যান। বিষয়টি তিনি তাৎক্ষণিকভাবে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে অবহিত করেন। পরে তার পরামর্শে লেবুয়াতকে হাতে কলমে ও সার্বক্ষণিক পরামর্শ প্রদান করা হয়। এ প্রসঙ্গে বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোতাহার হোসেন জানান, স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার কাছে খবর পেয়ে তিনি নিজে সার্বক্ষণিক এই ধানের ক্ষেতে বিশেষ নজরদারি করেছেন। ইতোমধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা লেবুয়াত শেখের এই ধানের ক্ষেত পরিদর্শন করে ধানের নমুনা সংগ্রহ করেছেন।
তিনি আরও জানান, এই বিশেষ জাতের ধানের নানা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি অনেক বেশি লবণ সহিষ্ণু জাত। গাছের কা- অনেক বেশি মোটা ও শক্ত, ফলে ঝরে হেলে পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই। বৈরী আবহাওয়ায়ও পাতায় কোন স্পট নেই। এই জাতের ধানের শীষ অনেক বেশি লম্বা এবং প্রতিটি শীষে এক হাজার থেকে ১১ শ’ দানা আছে, যা সাধারণ বিআর-২৮ জাতের ধানের থেকে ৬ গুণ বেশি।
কৃষিবিদ মোতাহার হোসেন বলেন, ‘এই ধানের শীষ প্রায় ১৫ ইঞ্চি লম্বা। পাতাগুলোও বেশ চওড়া প্রায় দেড় ইঞ্চির মতো। প্রতি শীষে এক হাজার থেকে ১১ শ’ দানা। এটা দেখে মনে হয়েছে এটি একটি বিরল প্রজাতির ধান।’
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে আশাপ্রদ হলো, এটি একটি ‘ফাইন রাইস’ প্রজাতির ধান। এই ধান ইতোমধ্যে অনেক বেশি সাড়া জাগিয়েছে। গবেষণা করে এটি যদি কৃষকদের জন্য উপযোগী করা যায়, তাহলে এই জাত সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া উচিত।’
এ প্রসঙ্গে বাগেরহাট জেলা বীজ প্রত্যয়ন কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান জানান, ‘কৃষক পর্যায়ে উদ্ভাবিত এটি একটি নতুন জাতের ধান। এই ধান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে। বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির মাধ্যমে এটি ছাড় করানোর ব্যবস্থা করা হবে।’
জানা যায়, ২০১৬ সালে বাড়ির পার্শ¦বর্তী একটি ক্ষেতে আফতাব-৫ জাতের হাইব্রিড ধানের চাষ করেছিলেন তিনি। ধান কাটতে থাকা দিন মজুরদের পানি খাওয়ানোর জন্য মাঠে যান তার মা ফাতেমা বেগম। এ সময় সেই ধানের ক্ষেতের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কয়েকটি বড় ধানের শীষ (ছড়া) দেখতে পান তিনি। এই শীষগুলো নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। পরে তিনি ওই ধানগুলো সংরক্ষণ করার জন্য লেবুয়াতকে নির্দেশ দেন। ২০১৭ সালে মাত্র এক শতক জমিতে তিনি ওই ধান রোপণ করে সেখান থেকে আড়াই কেজি বীজ সংগ্রহ করেন লেবুয়াত। এ বছর তিনি ৭৫ শতক জমিতে সেই ধান রোপণ করেছিলেন। সেই ৭৫ শতক জমিতে প্রায় এক শ’ মণ ধান উৎপাদিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে লেবুয়াত শেখের মা ফাতেমা বেগম বলেন, ‘দুই বছর আগে মাঠে ধান কাটতে থাকা কাজের লোকেরা পানি চাইলে আমি পানি দিতে যাই। এ সময় ধানের ভেতর একটি বড় ধরনের ধানের বাইল (শীষ) পাই। তখন মনে করলাম, এটি আবার কী ধান? একটু সামনে গিয়েই আরও দু’টি বাইল পাই।’
তিনি বলেন, ‘এই ধানগুলো নিয়ে বাড়ি এসে ছেলেকে দিলে সে বলল- এ দিয়ে আবার কি করতে হবে? তখন আমি বললাম, জমির এক কোণে ফেলে রাখব। পরে একটি কাঁচের বোতলে এটি সংরক্ষণ করি। পরের বছর এই ধান থেকে ৩ আঁটি ধান হয়। পরের বছরের জন্য বীজ হিসেবে তা রেখে দেই। সেখান থেকে আজ এতগুলো ধান হয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে লেবুয়াত শেখ বলেন, ‘প্রথম থেকেই কৃষি বিভাগের পরামর্শে কাজ করি। এতে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। আর এই ভিন্ন জাতের ধান দেখতে প্রতিদিনই অনেক লোক বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসছে। তারা ধান সংগ্রহের আগ্রহ প্রকাশ করছে।’
এ ধানের ব্যাপারে চাকুলী গ্রামের কৃষক মোস্তাফিজুর রহমান হাফিজ বলেন, ‘এই ধান নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব। প্রতিটি ধানের শীষ ১৩-১৫ ইঞ্চি লম্বা, প্রতি শীষে এক হাজার থেকে ১২শ’টি ধান রয়েছে। যার ওজন ৩০ থেকে ৪০ গ্রাম, যা দেশের অন্য কোন স্থানে আছে বলে আমরা কারও কাছে শুনিনি।’
এই ধানের বীজ সংগ্রহ করতে আসা কৃষাণী রীনা বেগম বলেন, ‘সবার আগ্রহ এখন লেবুয়াতের ধানের দিকে। এই ধান বীজ হিসেবে সংগ্রহ করতে প্রতিদিনই অনেক লোক আসছে। আমি নিজেও প্রতি কেজি ৪ শ’ টাকা দরে ৪ কেজি ধানের বীজ কিনেছি।’
সাধারণ ধানে যেখানে বিঘা প্রতি ফলন ১৮ মণ, সেখানে এই ধানে বিঘা প্রতি ফলন পাওয়া গেছে ৩৫ মণ, যা আশাবাদী করে তুলেছে কৃষি বিজ্ঞানীদেরও। সাধারণ ধানে যখন হেক্টর প্রতি সর্বোচ্চ ফলন গড়ে আট টন পাওয়া যায়, সেখানে লেবুয়াত শেখ ফলন পেয়েছেন ১১ টনের মতো। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বলছে, এই ধানে চিটা কমানো গেলে প্রতি হেক্টরে ফলন হতে পারে ১৫ টন পর্যন্ত। আর তা হলে কৃষিতে নতুন চমক হিসেবে দেখা দেবে লেবুয়াত শেখের নতুন জাতের ধান।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. শাহজাহান কবির বলেন, ‘এই ধানে চিটার পরিমাণ অনেক বেশি। এটা কমানো গেলে ফলন ১৫ টন পর্যন্ত নেয়া সম্ভব। সেজন্য ধানগুলোকে আমাদের ব্রিডিং ডিভিশনে দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ধারণা যেহেতু এই ধান হাইব্রিডের প্লটে পাওয়া গেছে, তাই এটা হতে পারে কোন আন লাইন। তাই গবেষণার মাধ্যমে নতুন এ ধানে স্থিতিশীলতা না আনা পর্যন্ত, একে আলাদা জাত হিসেবে ঘোষণা করা ঠিক হবে না। তা না হলে হরি ধান, কাপালী ধানের মতো এ ধানও অল্প দিনেই কৃষকের মাঠ থেকে হারিয়ে যাবে।’
বিস্ময়কর ধানের বৈশিষ্ট্য ॥ এই ধানের গাছ, ফলন, পাতা ও শীষ সবকিছু অন্য যেকোন জাতের ধানের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রতি গেছে একটি চারা রোপণ করা হয়। যা বেড়ে ৮-১২টি চারায় পরিণত হয়। প্রতিটি ধান গাছ ১১৫ থেকে ১৩০ সেন্টিমিটার লম্বা। এক একটি ছড়ার দৈর্ঘ্য ৩৬-৪০ সেন্টিমিটার। প্রতি ছড়ায় দানার সংখ্যা এক হাজার থেকে ১২শ’টি, যার ওজন ৩০-৩৫ গ্রাম। ধান গাছের পাতা লম্বায় ৮৮ সেন্টিমিটার, ফ্লাগলিফ (ছড়ার সঙ্গের পাতা) ৪৪ সেন্টিমিটার। ধান গাছের পাতা চওড়ায় দেড় ইঞ্চি। এই জাতের গাছের কান্ড ও পাতা দেখতে অনেকটা আখ গাছের মতো এবং অনেক বেশি শক্ত। একর প্রতি ফলন প্রায় ১৩০ মণ। অন্য যেকোন জাতের তুলনায় এই জাতের ধান অনেক আলাদা। এটি লবণ সহিষ্ণু জাত, কান্ড অনেক শক্ত এবং বিরূপ আবহাওয়ায় কোন প্রভাব পড়ে না এর ফলনে।
– See more at: http://www.dailyjanakantha.com/details/article/350728/%E0%A6%AB%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%A8-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%B8-%E0%A6%AB%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%9F%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%B7%E0%A6%95-%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%AC%E0%A7%81%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%A4-%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%96%E0%A7%87%E0%A6%B0#sthash.texNbQX8.dpuf